মির্জানগর হাম্মামখানা, যশোর

ঐতিহাসিকদের মতে, ১৬৪৯ সালে বাংলার সুবেদার শাহ শুজা তার শ্যালকপূত্র মির্জা সাফসি খানকে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। মির্জা সাফসি খান কেশবপুরে কপোঁতাক্ষ নদ এবং বুড়িভদ্রা ত্রিমোহনার সন্ধিস্থলের নিকটে বসতি স্থাপন করেন। জায়গাটি কেশবপুর সদর উপজেলা থেকে মাত্র ৭ কিমি দূরে অবস্থিত। তখন থেকেই মির্জা সাফসি খানের নাম অনুসারে এলাকাটির নাম রাখা হয় মির্জা-নগর। প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা এই হাম্মামখানাটি এখনও মোগল ঐতিহ্য ও স্থাপত্যকর্মের প্রতীক হিসাবে সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। আসুন মোগল সম্রাজ্যের অমূল্য এই নিদর্শন সম্পর্কে বিশদভাবে জেনে নেয়া যাক।

মির্জানগর হাম্মামখানার অবস্থান ও নামকরন

যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত কপোতাক্ষ ও বুড়িভদ্রা নদীর সন্ধিস্থলের নিকটে মির্জানগর হাম্মামখানার (Mirzanagar Hammamkhana) অবস্থান। মির্জানগর হাম্মামখানা ও স্থানটির নামকরন করা হয় ফৌজদার মির্জা সাফসি খানের নামে।

মির্জানগর হাম্মামখানাঃ ফিরে দেখা

১৬৪৯। বাংলার সূবেদার শাহ শুজার শ্যালকপূত্র মির্জা সাফসি খানকে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত করেন এবং এর মাধ্যমে যশোর অঞ্চলে মোগল কোনো ফৌজদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মির্জা সাফসি খান ফৌজদার হিসাবে তার দায়িত্ব পালনের লক্ষে বর্তমান কেশবপুরের উপজেলা সদর থেকে ৭ কিমি দূরে কপোতাক্ষ ও বুড়িভদ্রা নদীর মোহনার নিকটে বসবাস শুরু করেন এবং সেই থেকে এলাকাটি মির্জানগর বলে ডাকা শুরু হয়।

পরবর্তীতে আগ্রার সিংহাসনের নতুন মালিক হিসাবে সম্রাট আওরাঙ্গজেব আসীন হওয়ার পর যশোর অঞ্চলে নতুন ফৌজদার হিসাবে নুরুল্লা খাঁ নিযুক্ত হন। তখন তিনি বুডিভদ্রা নদীর পাড়ে কিল্লাবাড়ি স্থাপন করেন। নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে কিল্লাবাড়ির চারদিকে সূবিস্তৃত পরিখাঁ খনন করেন, দশফুট উচু প্রাচীর স্থাপন করে জোনানসহ হাম্মামখানা ও দূর্গের সদর তোরন নির্মান করেন। দূর্গটিকে সূরক্ষিত করার জন্য ফটকে কামান স্থাপন করেন। বর্তমানে মির্জানগরের কামানের একটি যশোর শহরের মনিহার মোড়ে শহীদদের বেদীতে সংরক্ষিত আছে।

মির্জানগর হাম্মামখানার বর্তমান অবস্থা ও যা যা দেখার আছে 

মোগল স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত মির্জানগরের এই দূর্গে হাম্মামখানা (গোসলখানা) ব্যতিত আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ১৯৯৬ সালে প্রত্নতত্ব বিভাগ এই স্থাপনাকে পুরাকীর্তি ঘোষনা করে এটিকে সংস্কার করে। কুপসমেত হাম্মামখানাটি মোগল স্থাপতাশৈলীর আলোকে পূর্ব-পশ্চিমে চারটি কক্ষে নির্মান করা হয়। যার পুর্বদিকের কক্ষদুটি চৌবাচ্চা হিসাবে ব্যবহৃত হতো। আর এ কারনে কক্ষ দুটির জানালা অপেক্ষাকৃত উচু রাখা হয় যাতে করে গোসলের সময় বাইরে থেকে দেখা না যায়। উল্লেখ্য সে সময় হাম্মাামখানায় পানি সরবরাহের জন্য পোড়ামাটির নল ব্যবহার করা হয়েছিল যা হা্ম্মামখানের ছাদে স্থাপিত চৌবাচ্চার সাথে সংযুক্ত ছিল। যা কিনা মোগল নির্মানশৈলীর প্রসিদ্ধতা, আভিজাত্য ও আধুনিকতাকে নির্দেশ করে।

কোথায় থাকবেন

সবচেয়ে ভালো হয় যদি দিনে গিয়ে দিনেই যশোর শহরে ফিরে আসা যায়। যশোর শহরে থাকার জন্য বেশ ভালো মানের অনেকগুলি হোটেল রয়েছে। তবে, চাইলে কেশবপুর উপজেলা সদরেও থাকতে পারেন। সেখানে সরকারী রেস্ট হাউজ গুলিতে আরামছে রাত কাটিয়ে দিতে পারবেন। আমার পরামর্শ হবে আপনি কেশবপুরে সরকারী রেস্ট হাউজে থাকুন। এতে করে হাম্মামখানা দেখার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি মধুপল্লী দেখতে পারবেন। আবার চাইলে মির্জানগর হাম্মামখানা দেখে মধুপল্লীতে গিয়ে সেখানে অবস্থিত পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেলেও থাকতে পারেন।

নিচে আমি আপনাদের সুবিধার্থে যশোর শহরের মানসম্মত হোটেল গুলির নাম এবং কেশবপুর উপজেলার সরকারী রেস্ট হাউজগুলার নাম উল্লেখপূর্বক যোগাযোগ নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।

যশোর শহরের হোটেলগুলিঃ

  • হোটেল জাবির ইন্টাঃ 
  • হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টাঃ
  • হোটেল হাসান ইন্টাঃ
  • হোটেল ম্যাগপাই
  • হোটেল আর এস ইন্টাঃ
  • হোটেল শামস ইন্টাঃ

কেশবপুরে অবস্থিত সরকারী রেস্টহাউজ সমুহের নাম ও ঠিকানা

  • জেলাপরিষদ ডাকবাংলো

কিভাবে যাবেন

দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন আগে যশোর শহরে চলে আসুন। যশোর শহরের সাথে সারাদেশেরই সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। 

ঢাকা থেকে যশোর

  • ঢাকা থেকে এর তিন উপায়েই যশোরে আসতে পারবেন। ঢাকার গাবতলী, শ্যামলী, কল্যানপুর, আব্দুল্লাহপুর, কলাবাগান, পান্থপথ ও বাড্ডা থেকে সরাসরি যশোরের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এসি বাসে ৮০০-১২০০ টাকা(সময়ভেদে) এবং নন-এসি বাসে ৪৫০-৪৮০ টাকা ভাড়া পড়বে। আকাশপথে প্লেনযোগে বাংলাদেশ বিমানসহ অন্যান্য সকল প্রাইভেট এয়ারওয়েজে দিনে দুই শিফটে ঢাকা থেকে যশোর যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে চাইলে শনিবার ছাড়া প্রতিদিন ভোর ৬ টা ২০ মিনিটে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধা ৭টায় আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেসে চড়ে যশোর যাওয়া যায়।

যশোর থেকে মির্জানগর হাম্মামখান ভায়া কেশবপুর

  • যশোর শহরে আসার পর আপনাকে যেতে হবে কেশবপুর উপজেলায়। কিভাবে যাবেন? ইজি বাইক বা রিকশায় চড়ে শহরের পুলেরহাট বাস স্টপেজে চলে আসুন। পুলের হাট বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বাসযোগে কেশবপুর উপজেলা সদরে যেতে পারবেন। ৩৫ কিমি দূরত্বের এ রুটে বাস ভাড়া পড়বে ৪০ টাকার মত(পরিবর্তন হতে পারে)। কেশবপুর উপজেলা সদরে পৌছার পর ভ্যান অথবা অটোতে চড়ে মির্জানগরের এই নবাববাড়ি পৌছাতে পারবেন।

কি কি কেনার আছে

মির্জানগর হাম্মামখানা বা কেশবপুরে বিশেষ কিছু কেনার না থাকলেও যেহেতু যশোর যাচ্ছেন, সেহেতু যশোরের বিখ্যাত জিনিসগুলো কিনতে বা স্বাদ নিয়ে দেখতে পারেন। নিচে আমি বিখ্যাত সেসব জিনিসের তালিকা দিয়ে দিচ্ছি।

  • জামতলার মিস্টি
  • খেজুরের গুড় ও পাটালী
  • প্যাড়া সন্দেশ
  • রসের পিঠা
  • চুকনগরের বিখ্যাত চুই ঝাল
  • ধর্মতলার মালাই চা

শেষকথা

মোগল নির্মানশৈলীতে নির্মিত অসাধারন এই পুরাকীর্তি দেখতে সারাদেশ থেকে পর্যটক ভিড় জমায়। আপনি যদি ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রেমিক হয়ে থাকেন তবে এই নিদর্শনে অবশ্যই ঘুরে আসা উচিত।

Published by সাদমান সাদ রাফি

ঘুরতে ভালবাসি!

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started