মাইকেল মধুসূদন দত্তের মধুপল্লী, সাগরদাড়ি

বাংলা সাহিত্যের এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবির নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত। অসাধারন মেধাবী এই কবি যেন সব্যসাচী। সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গনে তার অগাধ বিচরন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি দিয়েছেন দু’মুঠো ভরে। তার অনিন্দ্য সৃষ্টি সত্তা তাকে নিয়ে গেছে বাংলার চিরায়ত কবির মঞ্চে-তার কাব্য, উপন্যাস, গল্প স্থান পেয়েছে বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত সৃষ্টি তালিকায়। 

বাংলার সাহিত্যের সেই সু-মহান কবির জন্মস্থান সম্মুখ চোখ দ্বারা অবলোকন করার জাজ্জল্যকর এক ইচ্ছা সবসময় কাজ করত। কিন্তু সময় সংকুলানের কারনে সে ইচ্ছায় জল ঢেলে রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। প্রতিক্ষায় ছিলাম অধীর আগ্রহে। গতবছর হঠাৎ আমার সময় ও সাধ এক হয়ে গেল। মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান ঘুরে কেমন লাগল, কি কি দেখার  আছে, কিভাবে যাবেন-সহ আনুসাঙ্গিক নানা বিষয়ে আজ জানাবো আপনাকে।

কোথায় অবস্থিত

মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান তথা বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাড়ি গ্রামে। “সতত হে নদ্ তুমি পড় মোর মনে সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে” বিখ্যাত এ পঙক্তির মাধ্যমে নদী ও প্রকৃতির সাথে তার গভীর সম্প্রীতির কথা তুলে ধরেছেন। বলাই বাহুল্য সাগরদাড়ি গ্রামের কোল ঘেষে বয়ে চলা কপোতাক্ষ নদ কবির শৈশব ও কৈশোরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কবির বাড়ির ঠিক পাশ দিয়েই সুনসান নিরব এই শান্ত শ্যামল নদটি বয়ে চলে গেছে।

কিভাবে যাবেন

দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন আগে যশোর শহরে চলে আসুন। যশোর শহরের সাথে সারাদেশেরই সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। 

ঢাকা থেকে যশোর

ঢাকা থেকে এর তিন উপায়েই যশোরে আসতে পারবেন। ঢাকার গাবতলী, শ্যামলী, কল্যানপুর, আব্দুল্লাহপুর, কলাবাগান, পান্থপথ ও বাড্ডা থেকে সরাসরি যশোরের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এসি বাসে ৮০০-১২০০ টাকা(সময়ভেদে) এবং নন-এসি বাসে ৪৫০-৪৮০ টাকা ভাড়া পড়বে। আকাশপথে প্লেনযোগে বাংলাদেশ বিমানসহ অন্যান্য সকল প্রাইভেট এয়ারওয়েজে দিনে দুই শিফটে ঢাকা থেকে যশোর যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে চাইলে শনিবার ছাড়া প্রতিদিন ভোর ৬ টা ২০ মিনিটে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধা ৭টায় আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেসে চড়ে যশোর যাওয়া যায়।

যশোর থেকে সাগরদাড়ির মধুপল্লী

যশোর শহরে আসার পর আপনাকে যেতে হবে কেশবপুর উপজেলায়। কিভাবে যাবেন?

ইজি বাইক বা রিকশায় চড়ে শহরের পুলেরহাট বাস স্টপেজে চলে আসুন। পুলের হাট বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বাসযোগে কেশবপুর উপজেলা সদরে যেতে পারবেন। ৩৫ কিমি দূরত্বের এ রুটে বাস ভাড়া পড়বে ৪০ টাকার মত(পরিবর্তন হতে পারে)। কেশবপুর উপজেলা সদরে পৌছার পর সাগরদাড়ির মধুপল্লীতে যেতে হলে নিতে হবে সিএনজি, ভ্যান অথবা মাইক্রোবাস।

কোথায় থাকবেন

সবচেয়ে ভালো হয় যদি দিনে গিয়ে দিনেই যশোর শহরে ফিরে আসা যায়। যশোর শহরে থাকার জন্য বেশ ভালো মানের অনেকগুলি হোটেল রয়েছে। তবে, চাইলে কেশবপুর উপজেলা সদরেও থাকতে পারেন। সেখানে সরকারী রেস্ট হাউজ গুলিতে আরামছে রাত কাটিয়ে দিতে পারবেন। এছাড়া মধুপল্লীর পাশেই বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একটি মোটেল রয়েছে। সেখানে শ্রেনী ভেদে কক্ষপ্রতি ৬০০-১২০০ টাকা ভাড়ায় রাত্রি যাপন করতে পারবেন।

নিচে আমি আপনাদের সুবিধার্থে যশোর শহরের মানসম্মত হোটেল গুলির নাম এবং কেশবপুর উপজেলার সরকারী রেস্ট হাউজগুলার নাম উল্লেখপূর্বক যোগাযোগ নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।

যশোর শহরের হোটেলগুলিঃ

  • হোটেল জাবির ইন্টাঃ 
  • হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টাঃ
  • হোটেল হাসান ইন্টাঃ
  • হোটেল ম্যাগপাই
  • হোটেল আর এস ইন্টাঃ
  • হোটেল শামস ইন্টাঃ

কোথায় খাবেন

মধুপল্লীর আশেপাশেই খাবার হোটেলে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পেয়ে যাবেন।

কি কি কেনার আছে

যেহেতু যশোর যাচ্ছেন, সেহেতু যশোরের বিখ্যাত জিনিসগুলো কিনতে পারেন। নিচে আমি বিখ্যাত সেসব জিনিসের তালিকা দিয়ে দিচ্ছি। তাছাড়া আপনি যদি মধুমেলার সময় যেতে পারেন তবে কবির স্বারকগ্রন্থ, স্বারকলিপিসহ নানা রকম লোকজ দ্রব্যাদি কিনতে পারবেন। উল্লেখ্য, স্বারকগ্রন্থ, স্বারকলিপি সবসময়ই পাওয়া যায়।

  • জামতলার মিস্টি
  • খেজুরের গুড় ও পাটালী
  • প্যাড়া সন্দেশ
  • রসের পিঠা
  • চুকনগরের বিখ্যাত চুই ঝাল
  • ধর্মতলার মালাই চা

কি কি দেখার ও উপভোগ করা আছে

১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারী বাংলা সাহিত্যের চতুর্দশকবিতার স্রষ্টার জন্ম হয় যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাড়ি গ্রামে। কবির শৈশব এখানেই কাটে। কবির ব্যবহার করা কয়েকটি ভবন, তার ও তার পরিবারের বাবহার্য নানা স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র ও আলোকচিত্র নিয়ে গড়ে তোলা মধুসূদন জাদুঘর, লাইব্রেরি, পুকুরঘাট ও সাগরদাড়ি পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে গড়ে তুলে এর নামকরন হয়েছে মধুপল্লী। আপনার সুবিধার্তে মধুপল্লীতে কি কি দেখবেন তা এক ঝলকে বলে দিচ্ছি।

  • কবি মধুসূদন দত্ত ও তার পরিবারের ব্যাবহৃত ভবন। দোতলা ভবনের উপরের তলায় তিনটি শয়নকক্ষ ও নিচ তলার তিনটি কক্ষে মন্দির, জাদুঘর ও লাইব্রেরী রয়েছে।
  • মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির নিকটবর্তী বিখ্যাত কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী নৌ-ঘাট ( তৎকালীন জমিদার ঘাট) ও কাঠবাদাম গাছ। শ্রুতিত, কবি খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরের পর ১৮৬২ সালে নিজ বাড়িতে ফিরে আসলে তার পরিবার তাকে ফিরিয়ে দেয়। আপন আলয়ের মায়া না ছাড়তে পেরে প্রস্থান না করে অগত্যা কাঠবাদাম গাছতলায় তাবু খাটিয়ে ১৪ দিন অবস্থান করেন।
  • মধুসূদন ও তার পরিবারের ব্যবহৃত নানা স্মৃতি-বিজড়িত জিনিসপত্র ও কবির আলোকচিত্র নিয়ে গড়ে ওঠ মধুসূদন লাইব্রেরী। কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মধ্যে রয়েছে চেয়ার, খাট ও আলমারি।
  • বাড়ির উত্তরদিকের অসাধারন স্থাপত্য়শৈলীর ছাদহীন-দেয়াল ঘেরা ভেতরে তুলশী গাছ-এমন একটি কক্ষ।
  • বাড়ির প্রবেশদ্বার, অভ্যর্থনা মঞ্চ, সীমানা দেয়াল।( যা ১৯৬৮ সালে প্রত্নতত্ন বিভাগ বিভাগ পুনঃনির্মান করে)
  • ১৯৮৪ সালে শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাসের নির্মিত কবি মধুসূদন দত্তের আবক্ষ মূর্তি।
  • বিখ্যত কপোতাক্ষ নদ।
  • মধুমেলা। জাকজমকপূর্ন এই মেলা প্রতিবছর জানুয়ারী মাসের শেষসপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

প্রবেশ টিকিট ও সময়সূচী

এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে সন্ধা ৬ টা পর্যন্ত এবং অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত মধুপল্লী আগত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সরকার সকল ছুটিসহ মধুপল্লী সপ্তাহের প্রতি রবিবার বন্ধ থাকে।

শেষকথা

মাইকেল মধুসূদন দত্ত অতি অল্প সময় বাংলা সাহিত্যচর্চার সময় পেয়েছিলেন। তথাপ এই অত্যাল্প সময়ের মধ্যে সৃষ্টি করেন বাংলা সাহিত্যের অনন্য সব সৃষ্টি। অমর সেসব কাব্যগাথা বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ আর এই মহাকবিকে করেছে চিরস্বরনীয়। সেই মহান কবির জন্মস্থান, বসতবাড়ি, ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখা সৌভাগ্য সবার হয়ে ওঠেনা। আমি চাইনা আমার মুল্যবান ভ্রমন পিপাসু পাঠকও সেই দলভুক্ত হোক।

ভ্রমনান্দ উপভোগ করুন সেই আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিন। 

Published by সাদমান সাদ রাফি

ঘুরতে ভালবাসি!

One thought on “মাইকেল মধুসূদন দত্তের মধুপল্লী, সাগরদাড়ি

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started