ভাসমান সেতু, যশোর

ভাসমান সেতু

আপন শহর যশোর। তবে পড়াশুনার সূত্রে আপন নিবাসে আজ অতিথি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটূ ছুটি পেলেই ছুটে আসি দ্রুত বিক্ষেপে। সেবার সেমিস্টার ব্রেকে একটা লম্বা ছুটিতে এসেছিলাম। বাড়িতে থাকাকালীন বেশিরভাগ সময় কাটে স্কুলের বন্ধুদের সাথে নয়ত নদীর পাশে বসে প্রকৃতির। বাড়িতে আমার ছোট অনেকগুলো চাচাতো ভাই-বোন আছে। নদীর পাড়ে ওরাই আমাকে সঙ্গ দেয়। বেশ ভাল সময় কেটে যায়।

সেদিন, নদীর পাড়ের শান্ত-শ্যামল গাছপালা আর পাখির কলকাকলীতে মত্ত এক পড়ন্ত বিকালে বসে ওদের সাথে গল্প করছিলাম। কথায় কথায় একজন বলে উঠল, “ভাইয়া চল না কোথাও ঘুরে আসি”। আমি আবার ভাবলাম কোথায় আবার বেড়াতে যাব। ও নিজেই মনিরামপুরের ভাসমান ব্রিজ দেখতে যাবার প্রস্তাব দিল।

ভ্রমনকে যে নিঃশ্বাস নেয় এবং ভ্রমনান্দ যাকে স্বর্গীয় সুবাস দেয় সেই- আমি কি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারি 😊?

ভাসমান ব্রিজ কোথায় অবস্থিতঃ নামকরন ও অন্যান্য

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ঝাপা গ্রামে দেশের দীর্ঘতম এই ভাসমান সেতুটি অবস্থিত। যার নামকরন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ভাসমান সেতু। পরবর্তিতে যশোর জেলা প্রসাশনের সহায়তায় আরেকটি ভাসমান সেতু নির্মান করা হয় যা জেলা প্রসাশন ভাসমান সেতু নামে পরিচিত।

কিভাবে যাবেন

দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন সর্বপ্রথম যশোর শহরে চলে আসুন। সারাদেশের সাথে যশোরের সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ থাকায় নির্বিঘ্নে যশোর শহরে চলে আসতে পারবেন। এরপর রিকশা বা অটোতে করে শহরের মুড়লী অথবা পুলেরহাট বাসস্ট্যান্ডে চলে আসুন। মুড়লী বা পুলেরহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে মনিরামপুরে বাস যায়, চাইলে অন্যান্য লোকাল বাহনেও যাওয়া যায়। মনিরামপুর থেকে রাজগঞ্জ বাজারে চলে আসুন। রাজগঞ্জ বাজার থেকে ভ্যান বা অটোতে ঝাপা গ্রামে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌছতে পারবেন।

ভাসমান সেতুর পটভূমিঃ কি কি দেখার আছে

ভাসমান এই সেতুর পটভূমি জানা থাকলে কি কি দেখার আছে তা বুঝতে সহায়ক হবে। এই ভাসমান ব্রিজ শুধুই কি দেখার জন্য নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য সেটা জানা থাকলে বুঝতে পারবেন একতার বল কতটুকু, সামান্য গ্রামবাসীর ক্ষমতা কতটুকু আর তাদের উদ্দিপনার উৎসই বা কোথা থেকে আসে। আর তা জানলে নিঃসন্দেহে আপনার আত্নচেতনাবোধ জাগ্রত হয়ে আপনার অবচেতন মনকে উদ্দিপ্ত করে তুলবে।

যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলা। আয়তনের দিক দিয়েও তা বিশাল, দেশের ২য় বৃহত্তম উপজেলা এটি। সেই বিশাল আয়তনের উপজেলার আরেকটি বিশালত্ব হলো তার জলাধার। দেশের সর্ববৃহৎ এই জলাধারটি (বাওড়) উপজেলার ঝাপা নামক গ্রামে অবস্থিত। গ্রামের উপরেই নামকরন করা হয়েছে ঝাপা বাওড়। এ গ্রামে প্রায় ১৫ হাজার লোকের বসতি। গ্রামের মাঝখানে বিশাল এই বাওড় তাই তাদের যোগাযোগের এক বিশাল অন্তরায় ছিল এটি। মূলত সেই সমস্যার হাত ধরেই সেতুটির গোড়াপত্তন।

কিন্তু আসল কথা হলো, বিশাল প্রশস্ত এই বাওড়ে কিভাবে সেতুটি বানানো সম্ভব হলো? সরকারী কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে, চায়না কিংবা জাপানী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে নাকি অন্য কিছু ?

ভাসমান এ সেতুর বৈচিত্র ঠিক এই জায়গায়। না কোনো সরকারী সহায়তায় নয়- ঝাপা গ্রামের সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম ও একতাবদ্ধ প্রচেষ্টার ফসল এটি।

দেশের বৃহৎ এই জলাধার থেকে সরকার যখন বছরান্তে অর্ধকোটি টাকার খাজনা পেয়েও গ্রামবাসীর কষ্ট লাঘব করা থেকে বিরত থাকে, তখন গ্রামবাসীরা গঠন করে- ঝাপা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এবং এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থ, মেধা ও শ্রম ব্যয়পূর্বক সেতুটি তৈরি করে।

বলাই বাহূল্য, এই সেতু ও জলাধারের সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য ঘুরতে যাওয়া অপেক্ষা সাধারন গ্রামবাসীর বিশাল অর্জনের প্রত্যক্ষ সাক্ষীরূপে নিজেকে স্থাপন করা অধিকতর শ্রেয়। গভীর থেকে চিন্তা করলে এই কর্মযোগ্য মোটেও নগন্য মনে হবেনা তা এক বিশাল অর্জনকে স্বরন করিয়ে দেবে। একটু চিন্তা করলে হয়ত আপনার অবচেতন মন একজন সাধারন বাঙালী মানুষকে অসাধারন রূপে সরাসরি অনুমোদন দিয়ে দিবে। আরেকটু গভীরে গেলে হয়ত তা জাতীয় সত্বাবোধে অনুপ্রেরনা দিবে।

এসব ছাড়া আর কি কি দেখার ও উপভোগ করার আছে।

  • দেশের বৃহত্তম দৃষ্টিনন্দন দুইটি ভাসমান সেতু।
  • দেশের সর্ববৃহৎ বাওড়।
  • পড়ন্ত বিকেলে বাওড়ের স্বচ্ছতোয়া জলে মনোরম এক নৌকা ভ্রমনের দারুন অভিজ্ঞতা।
  • মিঠাপানির এই বাওডের সুন্দর পানিতে গোসল ও সাতার।
  • বিকাল বেলার ফটোগ্রাফি।

টিকেট ও আনুসাঙ্গিক খরচাপাতি

দেশের বৃহত্তম এই বঙ্গবন্ধু ভাসমান সেতুতে আরোহনের জন্য আপনাকে ৫ টাকা দিয়ে টিকেট কাটতে হবে।মূলত এই টাকা সেতুটির রক্ষনাবেক্ষন ও মেরামতের কাজে ব্যয় করা হয়ে থাকে। সেতুটির পাশে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যাবস্থা যার জন্য কোনো পয়সা দিতে হয়না। নৌকায় চড়ার জন্য নির্ধারিত ফি দেখিনি আমি। নিজের ইচ্ছামতো মাঝির সাথে দরদাম ঠিক করে নিতে হয়।

কোথায় খাবেন

ভাসমান সেতু সংলগ্ন পিকনিক স্পটে তেমন ভাল মানের খাবার হোটেল দেখতে পাইনি। এজন্য আমার পরামর্শ হবে “রাজগঞ্জ বাজারে যান, সেখানে ভাল মানের হোটেল পেয়ে যাবেন।“ ভাসমান সেতু থেকে নিকটেই রাজগঞ্জ বাজার।

কি কি কেনার আছে

ভাসমান ব্রিজ তথা মনিরামপুরে বিশেষ কিছু কেনার না থাকলেও যেহেতু যশোর যাচ্ছেন, সেহেতু যশোরের বিখ্যাত জিনিসগুলো কিনতে বা স্বাদ নিয়ে দেখতে পারেন। নিচে আমি বিখ্যাত সেসব জিনিসের তালিকা দিয়ে দিচ্ছি।

  • জামতলার মিস্টি
  • খেজুরের গুড় ও পাটালী
  • প্যাড়া সন্দেশ
  • রসের পিঠা
  • চুকনগরের বিখ্যাত চুই ঝাল
  • ধর্মতলার মালাই চা

কোথায় থাকবেন

সবচেয়ে ভালো হয় যদি দিনে গিয়ে দিনেই যশোর শহরে ফিরে আসা যায়। যশোর শহরে থাকার জন্য বেশ ভালো মানের অনেকগুলি হোটেল রয়েছে। তবে, চাইলে মনিরামপুরেও থাকতে পারেন। সেখানে সরকারী রেস্ট হাউজ গুলিতে আরামছে রাত কাটিয়ে দিতে পারবেন। নিচে আমি আপনাদের সুবিধার্থে যশোর শহরের মানসম্মত হোটেল গুলির নাম এবং মনিরামপুর উপজেলার সরকারী রেস্ট হাউজগুলার নাম উল্লেখপূর্বক যোগাযোগ নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।

যশোর শহরের হোটেলগুলিঃ

  • হোটেল জাবির ইন্টাঃ 
  • হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টাঃ
  • হোটেল হাসান ইন্টাঃ
  • হোটেল ম্যাগপাই
  • হোটেল আর এস ইন্টাঃ
  • হোটেল শামস ইন্টাঃ

মনিরামপুরে অবস্থিত সরকারী রেস্টহাউজ সমুহের নাম ও ঠিকানা

  • জেলাপরিষদ ডাকবাংলো( গার্ড-০১৯২৫২২৫৫১০)
  • পাট গবেষণা রেস্ট হা্‌উজ( ইউ জে আর ও-০১৭৪০৯১৬৯০২)
  •  পল্লী বিদ্যুৎ রেস্ট হাউজ( জি এম-০১৯৭৩২২৯৪৯০)

শেষকথা

দেশের বৃহত্তম ভাসমান এই সেতু আমার বেশ রোমাঞ্চকর লেগেছিল। বিশাল এক বাওড়ের স্বচ্ছ পানির উপর দিগন্তজোড়া নীল আকাশের ছায়াদ্বারা বেষ্টিত নীল রঙের ড্রামের উপর ভেসে থাকা সেতুটি নিঃসন্দেহে আপনাকে ছুয়ে ফেলবে। এভাবেএকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হয়ত সীমাহীন কল্পলোকের মহাব্যপ্তিতে ডুবে যাবেন 😊

Published by সাদমান সাদ রাফি

ঘুরতে ভালবাসি!

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started